বাংলাদেশ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে লোকসাহিত্যের একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু সেটা কোথায় তা নিয়ে ভাবার ব্যাপার আছে। লোকসাহিত্যের (folklore) মধ্যেও একটা সমাজজীবনের আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ চিত্র পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের লোকসাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ বলেই অনেক কথা বলার আছে।
রুশ লোককলাবিদ ওয়াই.এম.সকোলভ লোককলার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন: ‘Folklore is an echo of the Past and at the same time it is the vigorous voice of the Present. অর্থাৎ ‘লোককলা অতীতের প্রতিধ্বনি এবং একই সঙ্গে বর্তমানের বলিষ্ঠ কণ্ঠসর।’ আজকের বর্তমান এই স্বাধীন বাংলাদেশের যে নৃশংস-যন্ত্রণাদায়ক- গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামী অতীত ইতিহাস আছে তা বর্তমান প্রজন্মকে প্রতি পদক্ষেপে স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত নয় কি?
আমার মনে হয় নতুন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাঁদের পূর্বপুরুষদের সাহসী যুদ্ধের ইতিহাস জানা অতীব জরুরি। নতুবা দেশ যে কোনো সময় বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার হলে নতুন প্রজন্ম দেশবাঁচানো তো দূরে থাক, ঘর থেকে বাইরে বের হবে কিনা সন্দেহ। আশাকরি, এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয় অনেকটা অনুধাবন করতে পেরেছেন যে কেন আমি লোককলা তথা লোকসাহিত্য বিষয়টা আলোচনা প্রসঙ্গে টানলাম?
২. ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুটি অঞ্চল (পশ্চিম পাকিস্তান যা বর্তমানে পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান যা বর্তমানে বাংলাদেশ) গঠিত হলো এবং দু’ ভ‚খণ্ডের ধর্ম ব্যতীত তাঁদের ভাষা- সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি আলাদা থাকা সত্ত্বেও আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো উর্দু ভাষা। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে দিতে হলো রক্ত।
বাঙালিরা ভীরু-কাপুরুষ নয়; রক্ত দিয়ে বিদেশি শকুনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলো মাতৃভাষাকে। তাই বোধ করি ‘বাংলা’ শুধু মাত্র দুই অক্ষরের একটা শব্দ নয়। এটি পুরো বাঙালি জাতির অস্থিস্বরূপ। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বারবার বাংলা শব্দকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছে কিন্তু বাঙালি জাতি দুর্বার। তাই ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন :
বাঙালি জাতিকে বারবার মেধাশূন্য করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু যে জাতি দুর্দমনীয় তাঁদেরকে ধ্বংস করার চেষ্টা নিছক বোকামি। ছাত্ররা ১৯৬২ তে এসে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং ‘শিক্ষা সংকোচন নীতি’ পরিহার করে।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। এ সময়ে তিনি বলেন, ‘একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।…জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি-আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’। (তথ্যসংগ্রহ: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন পরিচয় (১৯৫৫-১৯৭৫), পৃ:২৯৭)। অথচ সমাজের অনেকের মধ্যে বিশেষত গ্রাম্য এলাকায় অনেকেই ‘বাংলাদেশ’ মুখে আনতে লজ্জা বোধ করে। মার্কেটে কেনাকাটা করতে করে গেলে তাদের প্রথমে দোকানিকে জিজ্ঞেস করতে হয়, ‘ভাই এটা ইন্ডিয়ান তো? ইন্ডিয়ান হলে নিব। তা না হলে নেব না।’
সে সময়ে ক্রেতাকে ‘বিদেশি পণ্য বর্জন’ করে ‘দেশীয় পণ্যতে’ উদ্বুদ্ধ করানোটা কি জরুরি নয়? দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের সকলের দেশের সংগ্রামী ইতিহাস জানা উচিত বলে মনে করি। যেমন অনেক বিজ্ঞ-জ্ঞানীরা বলেন, ছেলেমেয়ে যদি বাবা-মায়ের পরিশ্রমটা নিজ চোখে দেখে, উপলব্ধি করে তাহলে ছেলেমেয়ে উচ্ছৃৃঙ্খল না হয়ে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে এই ভেবে যে- তার বাবা-মা তাঁর জন্য পরিশ্রম করছে। তাকে তার মূল্য দিতে হবে। তাই বোধ করি সমাজের সকল শ্রেণির দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা অতীব জরুরি। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করার পরেও পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বাধিক আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো নানা ধরনের ক‚টনৈতিক চাল চালতে থাকে। শেষমেশ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভুট্টোর কূটনৈতিক চাল বুঝতে পেরে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ১৮ মিনিটের এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এবং স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।…রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। ’ সেদিন এই আন্দোলিত বক্তব্যে বাংলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো তাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। ইতিহাস- লোক-সাহিত্য-লোক-আন্দোলন যেমন অতীতের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না তেমনি ভবিষ্যতের জনগণকে দেশপ্রেম চেতনায় উজ্জীবিত করতে মুখ্য ভ‚মিকা পালন করে। তাই আমরা আজো যে কোনো স্বদেশবিরোধী আন্দোলনে ৫২’র কথা বলি, মুক্তির কথা বলি, স্বদেশের কথা বলি। কিন্তু শেষমেশ গিরগিটির ন্যায় ছদ্মবেশ ধরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নরপশুগুলো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড, বোমা, গুলিসহ হাজির হলো পূর্ব পাকিস্তানে তথা বাংলাদেশে। এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বললেন :
‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চ‚ড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’
৩. শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। পৃথিবীর ইতিহাসে রচিত হলো বাংলাদেশ অর্জনের এক সংগ্রামী ইতিহাস। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যেম ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে ‘বাংলাদেশ’-এর নাম স্থান করে নিল। তারপর আমরা বিজিত হয়ে ঘরে ফিরলাম। আমাদের কারো কারো মায়েরা থালাভর্তি ভাত নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। আমরা লাল-সবুজের পতাকা হয়ে আকাশে উড়াল দিয়ে মাকে জানান দিলাম ‘মা, আমার জন্য রাখা তোমার থালার ভাত জমিতে ছিটিয়ে দাও।’
আমরা বিজয়ের গান গাই। একটি প্রসঙ্গ টেনে আমি ইতি টানতে চাই যে, রোকেয়া সাখাওয়াত বাঙালিদের আঁতে ঘা লাগাতে নানা ব্যঙ্গাত্মক উক্তি করেছিলেন বটে তবে তা শুধুমাত্র বাঙালিদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে কিংবা সমাজ তথা দেশের উন্নতির জন্য। আমি এ কথা অস্বীকার করতে পারি না যে, বাঙালি জাতি বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর পদঘাতে পিষ্ট হলেও কখনো কারোর পদতলে আশ্রয় নেয়নি; কখনো কোনো বিদেশির অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করেনি; তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে চিরকাল।
সে মোগল সাম্রাজ্যই হোক কিংবা পলাশীর প্রান্তরেই হোক, কিংবা ৪৭ পরবর্তী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনামলেই হোক। শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’ গ্রন্থে বাঙালিদেও (বঙ্গীয় জনসাধারণ) প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছন যে, ‘বর্তমান বাঙালি জনসাধারণ তাঁহাদের বংশধর- যাঁহাদের দুর্দান্ত সাহসিকতা ও রণ-নৈপুণ্য দেখিয়া ইতিহাস-পূর্ব যুগে প্রসিদ্ধ রোমক কবি ভার্জিল লিখিয়াছিলেন-‘গঙ্গারাঢ়ীদের আশ্চর্য রণনৈপুণ্যের কথা বিজয় স্তম্ভে গজদন্তের ওপর স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়া রাখা উচিত।’
এক্ষণে কি বলতে পারি না যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার দামাল ছেলেরা তাঁদের নিজেদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে লাল-সবুজের পতাকা এঁকে যে সাহসিকতার পরিচয় দিলেন তা ‘গজদন্তের ওপর স্বর্ণাক্ষরে লেখার ন্যায়’ বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা সারাদেশের প্রতিটি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হোক! বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত হওয়া উচিত যার গুরুত্ব আমি আমার ভবিষ্যতব্য গবেষণা কাজের জন্য তথ্য সংগ্রহ করার সময় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্ম (বাচ্চারা) মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনাবগত। আমাদের উচিত নয় কি বাচ্চাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে? আমি বোধ করি মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ বিষয়ক একটা পাঠ্যবই প্রাথমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা গেলে আমাদের ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দ্রুত প্রজ্বালিত হয়ে উঠত। পক্ষান্তরে এদেশীয় রাজাকারদের সমূলে উৎপাটন না করা হলে দেশের মঙ্গল নেই। বোধ করি দেশের আনাচে-কানাচে আজো দেশবিরোধী রাজাকাররূপী জনগণ মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের মুখোশ টেনে না খুলতে পারলে বিজয়ের আনন্দ পরিপূর্ণভাবে পাব না।